জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি নিয়ে কবিতা পড়ুন (জনপ্রিয় কবিতাগুলো)

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একজন জনপ্রিয় কবি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশ। তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। জীবনানন্দ তার কাব্যে গ্রাম বাংলার সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন। অনেকেই জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি নিয়ে কবিতা খুজে থাকেন। যদি আপনি জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি নিয়ে কবিতা চান তাহলে এই পোস্ট আপনার জন্য। 


এই পোস্টে জীবনানন্দ দাশের জনপ্রিয় সকল প্রকৃতি নিয়ে কবিতা দেয়া হবে। আপনারা এই পোস্ট থেকে জীবনানন্দ দাশের সকল প্রকৃতি নিয়ে কবিতা জানতে পারবেন। এখানে দেয়া সকল কবিতা আপনাদের ভালো লাগবে। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত সকল প্রকৃতি নিয়ে কবিতা জানতে সম্পূর্ণ পোস্ট পড়তে ভুলবেন না-


জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি নিয়ে কবিতা


জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি নিয়ে কবিতাঃ 

জীবনানন্দ দাশ একজন প্রকৃতিপ্রেমী কবি ছিলেন। তার কাব্যে তিনি গ্রাম বাংলার সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন। প্রকৃতি নিয়ে জীবনানন্দ দাশের সকল কবিতা সবার মাঝে জনপ্রিয়। 


তার কাব্যে প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য থাকায় তাকে রূপসী বাংলার কবি বলা হয়। এছাড়াও তিনি প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লেখায় তাকে নির্জনতম কবিও বলা হয়। নিম্নে জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি নিয়ে কবিতা দেয়া হলো- 


আবার আসিব ফিরে 

(জীবনানন্দ দাশ) 


আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে,

এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়, 

হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে; 

হয়তো ভোরের কাক হয়ে 

এই কার্তিকের নবান্নের দেশে

কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন 

আসিব এ কাঠাঁল-ছায়ায়;

হয়তো বা হাঁস হবো 

কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,

সারাদিন কেটে যাবে কলমির 

গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে;

আবার আসিব আমি বাংলার 

নদী মাঠ খেত ভালোবেসে

জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা 

বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;

হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন 

উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;

হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেচাঁ 

ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;

হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে 

শিশু এক উঠানের ঘাসে;

রূপসার ঘোলা জলে হয়তো 

কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে

ডিঙা বায়; — রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে 

অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে

দেখিবে ধবল বক; 

আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে। 


বনলতা সেন 

(জীবনানন্দ দাশ)


হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।


চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর

হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’

পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।


সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন

সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;

পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। 


আট বছর আগে একদিন

(জীবনানন্দ দাশ - মহাপৃথিবী)


শোনা গেল লাশকাটা ঘরে

নিয়ে গেছে তারে;

কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আধারে

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাদ

মরিবার হল তার সাধ।


বধু শুয়ে ছিল পাশে-শিশুটিও ছিল;

প্রেম ছিল, আশা ছিল জোছনায় তবু সে দেখিল

কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?

অথবা হয় নি ঘুম বহুকাল- লাশকাটা ঘরে মুয়ে ঘুমায় এবার।


এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!

রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি

আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার

কোনোদিন জাগিবে না আর।


‘কোনদিন জাগিবে না আর

জানিবার গাঢ় বেদনার

অবিরাম অবিরাম ভার

সহিবে না আর-’

এই কথা বলেছিল তারে

চাঁদ ডুবে চলে গেলে অদ্ভুত আঁধারে

যেন তার জানালার ধারে

উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিত্বব্ধতা এসে।

তবুও তো পেঁচা জাগে;

গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে

আরেকটি প্রভাতের ইশারায়–অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।


টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে

চারি দিকে মশারির ক্ষমাহিন বিরুদ্ধতা;

মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোতে ভালোবাসে।


রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;

সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি।

ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন কোন্ বিকীর্ণ জীবন

অধিকার করে আছে ইহাদের মন:

দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘর শিহরণ

মরণেরাসথে লড়িয়াছে;

চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে

একা গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা;

যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাতে তার হয় নাকো দেখা

এই জেনে।


অশ্বত্থের শাখা

করে নি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে

সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে

করে নি কি মাখামাখি?

বলে নি কি: বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?

চমৎকার!

ধরা যাক দু-একটা ইদুর এবার!

জানায় নি পেচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?


জীবনের এই স্বাদ- সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের-

তোমার অসহ্য বোধ হল;

মর্গে কি ওমোটে

থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে!


শোনো

তবু এ মৃতের গল্প;-কোনো

নারীর প্রণয়ের ব্যর্থ হয় নাই;

বিবাহিতা জীবনের সাধ

কোথাও রাখে নি কোনো খাদ,

সময়ের উদবর্তনে উঠে এসে বধূ

মধু-আর মননের মধু

দিয়েছে জানিতে

হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে

এ জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;

তাই লাশকাটা ঘরে

চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।


জানি-তবু জানি

নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;

অর্থ নয়, র্কীতি নয়, সচ্ছলতা নয়-

আরো এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে

আমাদের ক্লান্ত করে;

ক্লান্ত ক্লান্ত করে:

লাশকাটা ঘরে

সেই ক্লান্তি নাই;

তাই লাশকাটা ঘরে

চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।


তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,

থুরথুরে অন্ধ পেচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে

চোখ পালটায় কয়: বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?

চমৎকার!

ধরা যাক দু একটা ইদুর এবার–

হে প্রগাঢ় পিতামহী , আজও চমৎকার?

আমিও তোকার মতো বুড়ো হব–বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব

কালীদহে বেনো জলে পার;

আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার। 


অদ্ভুত আঁধার এক

জীবনানন্দ দাশ- 


অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি

এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়

মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা

শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়। 


সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়

(জীবনানন্দ দাশ - ঝরা পালক) 


চোখ দুটো ঘুমে ভরে

ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে!

ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন,- স্বপন ক’দিন রয়!

এসেছে গোধূলি গোলাপিবরণ,-এ তবু গোধূলি নয়!

সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়,

আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের’পরে!


         কেটেছে যে নিশি ঢের,-

এতদিন তবু অন্ধকারের পাইনি তো কোনো টের!

দিনের বেলায় যাদের দেখিনি-এসেছে তাহারা সাঁঝে;

যাদের পাইনি পথের ধূলায়-ধোঁয়ায়-ভিড়ের মাঝে,-

শুনেছি স্বপনে তাদের কলসী ছলকে,- কাঁকন বাজে!

আকাশের নীচে- তারার আলোয় পেয়েছি যে তাহাদের!


        চোখ দুটো ছিল জেগে

কত দিন যেন সন্ধ্যা-ভোরের নট্কান -রাঙা মেঘে!

কত দিন আমি ফিরেছি একেলা মেঘলা গাঁয়ের ক্ষেতে!

ছায়াধূপে চুপে ফিরিয়াছি প্রজাপতিটির মতো মেতে

কত দিন হায়!- কবে অবেলায় এলোমেলো পথে যেতে

ঘোর ভেঙে গেল,- খেয়ালের খেলাঘরটি গেল যে ভেঙে।


দুটো চোখ ঘুম ভরে

ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে!

ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন,-স্বপন কদিন রয়!

এসেছে গোধূলি গোলাপিবরণ,-এ তবু গোধুলি নয়!

সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়,-

আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের’ পরে ! 


শঙ্খমালা

(জীবনানন্দ দাশ - বনলতা সেন) 


কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে

সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,

বলিল, তোমারে চাই:

বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ

খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়-


সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক

জোনাকির দেহ হতে-খুজেছি তোমারে সেইখানে-

ধূসর পেচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে

ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে

সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে

তোমারে খুঁজছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।


দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;

সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা-

বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,

শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।


কড়ির মতন সাদা মুখ তার;

দুইখানা হাত তার হিম;

চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম

চিতা জ্বলে: দক্ষিণ শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়

সে আগুনে হায়।


চোখে তার

যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!

স্তন তার

করুণ শঙ্খের মতো – দুধে আর্দ্র-কবেকার শঙ্খিনীমালার!

এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর। 


আকাশলীনা

(জীবনানন্দ দাশ - সাতটি তারার তিমির) 


সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়োনাকো তুমি,

বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;

ফিরে এসো সুরঞ্জনা:

নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;


ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;

ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;

দূর থেকে দূরে – আরও দূরে

যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।


কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!

আকাশের আড়ালে আকাশে

মৃত্তিকার মতো তুমি আজ:

তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।


সুরঞ্জনা,

তোমার হৃদয় আজ ঘাস :

বাতাসের ওপারে বাতাস -

আকাশের ওপারে আকাশ।


চাঁদিনীতে

(জীবনানন্দ দাশ - ঝরা পালক) 


বেবিলোন কোথা হারায়ে গিয়েছে,-মিশর-‘অসুর’ কুয়াশাকালো;

চাঁদ জেগে আছে আজো অপলক,- মেঘের পালকে ঢালিছে আলো!

সে যে জানে কত পাথারের কথা,- কত ভাঙা হাট মাঠের স্মৃতি!

কত যুগ কত যুগান্তরের সে ছিল জ্যোৎস্না, শুক্লাতিথি!

হয়তো সেদিনো আমাদেরি মতো পিলুবারোয়াঁর বাঁশিটি নিয়া

ঘাসের ফরাশে বসিত এমনি দূর পরদেশী প্রিয় ও প্রিয়া!

হয়তো তাহারা আমাদেরই মতো মধু-উৎসবে উঠিত মেতে

চাঁদের আলোয় চাঁদমারী জুড়ে,- সবুজ চরায়,- সবজি ক্ষেতে!

হয়তো তাহার দুপুর- যামিনী বালুর জাজিমে সাগরতীরে

চাঁদের আলোয় দিগদিগন্তে চকোরের মতো চরিত ফিরে !

হয়তো তাহারা মদঘূর্ণনে নাচিত কাঞ্চীবাধঁন খুলে

এম্নি কোন এক চাঁদের আলোয়,-মরু- ‘ওয়েসিসে’ তরুর মূলে!

বীর যুবাদল শত্রুর সনে বহুদিনব্যাপী রণের শেষে

এম্নি কোন এক চাঁদিনীবেলায় দাঁড়াত নগরীতোরণে এসে!

কুমারীর ভিড় আসিত ছুটিয়া, প্রণয়ীর গ্রীবা জড়ায়ে নিয়া

হেঁটে যেত তারা জোড়ায় জোড়ায় ছায়াবীথিকার পথটি দিয়া!

তাদের পায়ের আঙুলের ঘায়ে খড়- খড় পাতা উঠিত বাজি,

তাদের শিয়রে দুলিত জ্যোৎস্না- চাঁচর চিকন পত্ররাজি!

দখিনা উঠিত মর্মরি মধুবনানীর লতা-পল্লব ঘিরে,

চপল মেয়েরা উঠিত হাসিয়া,-‘এল বল্লভ,-এল রে ফিরে!’

-তুমি ঢুলে যেতে, দশমীর চাঁদ তাহাদের শিরে সারাটি নিশি,

নয়নে তাদের দুলে যেতে তুমি,-চাঁদিনী-শরাব,- সুরার শিশি!

সেদিনো এম্নি মেঘের আসরে জ্বলছে পরীর বাসরবাতি,

হয়তো সেদিনো ফুটেছে মোতিয়া,-ঝরেছে চন্দ্রমল্লীপাঁতি!

হয়তো সেদিনো নেশাখোর মাছি গুমরিয়া গেছে আঙুরবনে,

হয়তো সেদিনো আপেলের ফুল কেপেঁছে আঢুল হাওয়ার সনে!

হয়তো সেদিনো এলাচির বন আতরের শিশি দিয়েছে ঢেলে,

হয়তো আলেয়া গেছে ভিজা মাঠে এমনি ভূতুরে প্রদীপ জ্বেলে !

হয়তো সেদিনো ডেকেছে পাপিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া ‘সরো’র শাখে,

হয়তো সেদিনো পাড়ার নাগরী ফিরেছে এমনি গাগরি কাঁখে!

হয়তো সেদিনো পানসী দুলায়ে গেছে মাঝি বাকাঁ ঢেউটি বেয়ে,

হয়তো সেদিনো মেঘের শকুনডানায় গেছিল আকাশ ছেয়ে!

হয়তো সেদিনো মানিকজোড়ের মরা পাখাটির ঠিকানা মেগে

অসীম আকাশে ঘুরেছে পাখিনী ছট্‌ফট্‌ দুটি পাখার বেগে!

হয়তো সেদিনো খুর খুর ক’রে খরগোশছানা গিয়েছে ঘুরে

ঘন-মেহগিনি- টার্পিন- তলে- বালির জর্দা বিছানা ফুঁড়ে!

হয়তো সেদিনো জানালার নীল জাফরির পাশে একেলা বসি

মনের হরিনী হেরেছে তোমারে-বনের পারের ডাগর শশী!

শুক্লা একাদশীর নিশীথে মণিহরমের তোরণে গিয়া

পারাবত-দূত পাঠায়ে দিয়েছে প্রিয়ের তরেতে হয়তো প্রিয়ো!

অলিভকুঞ্জে হা হা ক’রে হাওয়া কেঁদেছে কাতর যামিনী ভরি!

ঘাসের শাটিনে আলোর ঝালরে ‘মার্টিল’ পাতা প’ড়েছে ঝরি!

‘উইলো’র বন উঠেছে ফুঁপায়ে,-‘ইউ’ তরুশাখা গিয়েছে ভেঙে,

তরুনীর দুধ-ধবধবে বুকে সাপিনীর দাঁত উঠেছে রেঙে!

কোন্‌ গ্রীস,- কোন্‌ কার্থেজ, রোম, ‘ত্রুবেদু’র- যুগ কোন,-

চাঁদের আলোয় স্মৃতির কবর- সফরে বেড়ায় মন!

জানি না তো কিছু,-মনে হয় শুধু এম্নি তুহিন চাঁদের নিচে

কত দিকে দিকে-কত কালে কালে হ’য়ে গেছে কত কী যে!

কত যে শ্মশান,-মশান কত যে,-কত যে কামনা- পিপাস-আশা

অস্তচাঁদের আকাশে বেঁধেছে আরব-উপন্যাসের বাসা! 


ঘাস 

(জীবনানন্দ দাশ - বনলতা সেন) 


কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয় 

পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা; 

কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস- তেমনি সুঘ্রাণ - 

হরিনেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে !

আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে গেলাসে পান করি,

এই ঘাসের শরীর ছানি- চোখে ঘসি, 

ঘাসের পাখনায় আমার পালক,

ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার শরীরের সুস্বাদু অন্ধকার থেকে নেমে। 


অন্ধকার

(জীবনানন্দ দাশ - বনলতা সেন) 


গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;

তাকিয়ে দেখলাম পান্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া

             গুটিয়ে নিয়েছে যেন

কীর্তিনাশার দিকে।


ধারসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম- পউষের রাতে-

             কোনোদিন আর জাগব না জেনে

কোনোদিন জাগব না আমি- কোনোদিন জাগব না আর-


হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,

তুমি দিনের আলো নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও,

হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে

রয়েছে যে অগাধ ঘুম

সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই,

তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও-

জানো না কি চাঁদ,

নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,

জানো না কি নিশীথ,

আমি অনেক দিন-

অনেক অনেক দিন

অন্ধকারের সারাৎসারে অন্তত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে

হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে

             বুঝতে পেরেছি আবার;

ভয় পেয়েছি,

পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;

দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে

মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য

             আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;

আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়- বেদনায়- আক্রোশে ভরে গিয়েছে;

সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের   

            আর্তনাদে উৎসব শুরু করেছে ।                     

হায়, উৎসব!   

হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে

আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,

অন্ধকারের স্তনের যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে

             থাকতে চেয়েছি।


কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি।

হে নর, হে নারী,

তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন;

আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।

যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ

সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,

শত শত শূকরের চিৎকার সেখানে,

শত শত শূকরের প্রসববেদনার আড়ম্বর;

এই সব ভয়াবহ আরতি!


গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;

আমাকে কেন জাগাতে চাও?

হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, 

          হে হিম হাওয়া,

আমাকে জাগাতে চাও কেন।

অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠব না আর;

তাকিয়ে দেখব না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে

             অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে

কীর্তিনাশার দিকে।


ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব-ধীরে-পউষের রাতে। 

কোনদিন জাগব না জেনে-

কোনোদিন জাগব না আমি-কোনোদিন আর। 


এই ছিল জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি নিয়ে কবিতা। উপরে জীবনানন্দ দাশের জনপ্রিয় কিছু প্রকৃতি নিয়ে কবিতা দেয়া হয়েছে। তবে এগুলো ছাড়াও জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতি নিয়ে আরো কবিতা লিখেছেন। এই পোস্টে নিয়মিত আরো জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি নিয়ে কবিতা যুক্ত করা হবে। 

আরো পড়ুনঃ জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতা

উপসংহারঃ 

জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি নিয়ে কবিতা নিয়ে এই পোস্ট যদি আপনাদের ভাল লাগে এবং কাজে আসে তাহলে কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। এছাড়াও যদি আপনাদের কোথাও বুঝতে সমস্যা হয় অথবা জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি নিয়ে আরো কবিতা চান তাহলে কমেন্টে জানাতে পারেন। তবে এরকম কবিতা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক, ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব ও গুগল নিউজে ফলো দিয়ে পাশে থাকতে ভুলবেন না। 

Share This Article On:

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url